Wednesday, May 8, 2024

মন জাগ' মঙ্গললোকে - ১

আজ ২৫শে বৈশাখ, ১৪৩১ - বিশ্ববরেণ্য কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৪তম জন্মদিন বা ১৬৩তম জন্ম বার্ষিকী। "ত্রিশরণ কৃপা" নামক একটি অনলাইন অনুষ্ঠান রবি ঠাকুরের জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে কয়েকজনকে নিয়ে একটি গীতি-কাব্য আলেখ্য'র মত লেখা হয়েছিল - খুব সম্ভবত  ২০২১ সালে। আজকের দিনে সেটিকে অনলাইনে প্রকাশ করতে পেরে ভালই লাগছে। এই বছরেও আজকে ত্রিশরণ কৃপা'র অনুষ্ঠানে একইরকম পরিবেশন হল। মূল লেখা থেকে একটি গান (আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু) ও একটি কবিতার (জীবন মরণ) বদলে অন্য একটি গান (সংশয়তিমিরমাঝে না হেরি গতি হে) এবং অন্য একটি কবিতা (পরিচয়) পরিবেশিত হল। মূল লেখার সঙ্গে এইদুটিও যুক্ত করে দেওয়া হল। "শেষ সপ্তক" থেকে অংশটাও এইবারের পরিবেশনায় যুক্ত হয়েছে। পাঠকবর্গ বা শিল্পীবর্গ নিজেদের মত করে অংশবিশেষ নিয়ে তাদের নিজেদের মত করে অনুষ্ঠান করে, খুব ভাল লাগবে।    

--------------------------------------------------------------------------------------

মন জাগ’ মঙ্গললোকে

  ----- শুভেন্দু মাইতি এবং

 দীপক শীল, শুভশ্রী ভেঙ্কটরমন, মীরা চ্যাটার্জ্জী, ছন্দা চক্রবর্তী

 

“জীবনের আশি বছর অব্দি চাষ করেছি অনেক । সব ফসলই যে মরাইতে জমা হয় তা বলতে পারিনে --- কিছু ইঁদুরে খাবে, তবুও বাকি থাকবে কিছু । জোর ক’রে বলা যায় না । যুগ বদলায়, কাল বদলায়, তার সাথে সব কিছুই তো বদলায়, কিন্তু সবচেয়ে স্থায়ী আমার গান – এটা জোর ক’রে বলতে পারি । বিশেষ করে বাঙালীরা শোকে-দুঃখে, সুখে-আনন্দে, আমার গান না গেয়ে তাদের উপায় নেই । যুগে যুগে এ গান তাদের গাইতেই হবে ।” - জীবন স্মৃতি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

------------------------------------------------------------------------------------------

মন জাগ’ মঙ্গললোকে ---

বিশ্বের সাথে জাগ’ অভয় অশোকে

১৯১৫ (৫৪), পূজা (জাগরণ), রামকেলী, ত্রিতাল

 

১) ত্রিশরণ কৃপায় (অনলাইন) রোজ সন্ধ্যায়, ঠাকুর, মা, স্বামীজী ও তাঁদের গৃহী এবং সন্ন্যাসী ভক্তবৃন্দের স্মরণ-মনন করে আমাদের সময় কাটে । আমাদের সুবিধা-অসুবিধা’কে সঙ্গে করেও আমরা প্রত্যেকে প্রত্যহ এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে, দিব্য ত্রয়ীর চরণে নিজেদেরকে আত্মসমর্পণ করার চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখি না । রোজই শুনি, কিন্তু তবু যেন মন ভরে না । পরমাত্মার সেই চিন্তনে ডুব দিতে মন আকুল, কিন্তু পরমানন্দ অধরা – তাই কবির ভাষায় আমাদের আকুল প্রার্থণা ---

নিত্য তোমার যে ফুল ফোটে ফুল বনে

১৯১৩ (৫২), শান্তিনিকেতন, পূজা (বিশ্ব), ইমন-বাউল, একতাল

 

২) ১৯১৪ সালে শান্তিনিকেতনে থাকাকালীন রচিত "দাঁড়িয়ে আছো তুমি আমার গানের ওপারে" গানটি । কবির অনেক গানই ঠিক করে পর্যায় ভাগ করা যায় না - যেমন এই গানটি ।  গানটিতে কবিমানসীর প্রতি আকুল নিবেদন ফুটে উঠেছে এবং এর সুরের মাধ্যমে যেন কবির আত্মনিবেদনের সুরটি ধ্বনিত হয়েছে। চিরকাল কবির জীবন তরী বয়ে চলেছে তাঁর মানস প্রতিমার সান্নিধ্যে, কিন্তু অধরাই থেকে গেছে সেই অনুভব। তাইতো কবি বলছেন ,"আমার সুরগুলি পায় চরণ ,আমি পাই না তোমারে।" আবার একই সঙ্গে, পূজার ভঙ্গীটিও এখানে যেন মূর্ত হচ্ছে । ঈশ্বরকে পাওয়ার যে আকাঙ্ক্ষা তা চরিতার্থ না হওয়ার বেদনায় কবি বারবার আকুল প্রার্থনা জানাচ্ছেন, "এসো এসো, পার হয়ে মোর জীবন মাঝারে "। কিভাবে পার হবে? কবি’র আকূতি – “কবে নিয়ে আমার বাঁশি বাজাবে গো আপনি আসি” অর্থাৎ তুমি আপনি এসে আমার এই প্রাণ-রূপ বাঁশিটিরে বাজিয়ে পার কর – অর্থাৎ আমার হৃদিপদ্মে বিরাজ কর ।

গানটি ইমন রাগের ওপর ভিত্তি করে সুরারোপ করা হয়েছে।

দাঁড়িয়ে আছো তুমি আমার গানের ওপারে

১৯১৪ (৫২), শান্তিনিকেতন, পূজা (গান), ইমন, ত্রিতাল

 

৩) তিনি যেন পরশপাথর । জীবন-লাভের যে উদ্দেশ্য সর্বময় ঈশ্বর ঠিক করে রেখেছেন, তার ঠিকানা লেখা রয়েছে যেন ওই পরশপাথরে । তাঁর ওই পরশপাথরের ছোঁয়াটা পেলেই যেন সিঁড়ির সপ্তম ধাপে আমরা পৌঁছে যাব । আর সপ্তম ধাপে পৌঁছে গেলেই ছাদের দরজায় পৌঁছে যাওয়া – তাই খ্যাপা সারাদিন ধরে খোঁজ করে পরশপাথরের । যে পরশপাথরের ছোঁয়া একবার পেলে – (মন) বার বার (সেই পরশ) পেতে চায় ...

পরশপাথর

১৮৮১ (২০), শান্তিনিকেতন, জ্যৈষ্ঠ

 

৪) “সংসার যবে মন কেড়ে লয়,

                   জাগে না যখন প্রাণ,

তখনো, হে নাথ, প্রণমি তোমায়

                   গাহি বসে তব গান ।।

অন্তর্যামী, ক্ষমো সে আমার শূন্য মনের বৃথা উপহার ---

পুষ্পবিহীন পূজা-আয়োজন ভক্তিবিহীন তান ।। ”

ঈশ্বর বিরহে রবীন্দ্রনাথের কাতর চিত্ত যখনই আলোড়িত হয়েছে, তখনই তাঁর হৃদয় এক অনন্য প্রার্থণায় ডুব দিয়েছে যা লিপিবদ্ধ হয়ে রয়েছে তাঁর বিভিন্ন সংগীতে । হৃদয় দেবতার উদ্দেশ্যে এমনই এক রচনায় তিনি তাঁর ব্যাকুলতা প্রকাশ করে বলেছেন, ---

হৃদয়নন্দন বনে

১৮৯৪ (৩২), পূজা (বিরহ), মিশ্র-পঞ্চম/সৌহিনী ললিতা, ঝাঁপতাল

 

৫) ভক্ত আর ভগবান একে অপরেরর কাছে বাঁধা!! ভক্ত যেমন তার ভক্তি দিয়ে ভগবানকে বেঁধে রেখেছে, কৃপাময় ভগবানও তেমনি ভক্তহৃদয়ে থাকতেই বেশি আনন্দ পান। তবে কি তিনি সব হৃদয়ে নেই? না না, তা কেন হবে – তিনি সবার মধ্যেই আছেন। তবে তাঁর প্রকাশ একজনের মধ্যে বেশি, আর একজনের মধ্যে কম কেন? তাঁকে খুঁজছে কয়জনে? যে যেমন তাঁর খোঁজ করে, সে তেমন তাঁর হদিস পায় । আমি যে কাপড়টি পরে বের হব ভাবছি, সে কাপড়টি বিশ’খানা কাপড়ের তলায় যদি ঢাকা পড়ে থাকে, তবে তো তার হদিস পেতে সময় লাগবে! তাই নয় কি? মন যদি মলিন হয় – তবে তো তাঁর হদিস পেতে সময় লাগবে! মলিনতা দূর হলেই, যে ঈশ্বর অন্তরের গভীরে নিত্য জেগে রয়েছেন, তিনি ভক্তপ্রাণের প্রেমে নিজেকে পরিপূর্ণরূপে প্রকাশ ঘটাবেন – তখনই “তোমার আনন্দ” “আমার পর”!!

তাই তোমার আনন্দ আমার পর

১৯১০ (৪৯), জানিপুর, পূজা (নিঃসংশয়), দেশ, দাদরা

 

৬) “আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার,

          পরানসখা বন্ধু হে আমার ।’

  --- প্রেমিক কবি তার অন্তরতম পরানসখা বন্ধুর প্রতীক্ষায় । চৈতন্য বা মুক্তিস্বরূপ যে অস্তিত্ব, তাকে পরিপূর্ণ, অবাধ ও অনাবৃতভাবে পাওয়াতেই তো মিলন --- আর এই মিলনের জন্য ব্যাকুলতাই তো অভিসার । এই অভিসার তো তীব্র আত্মানুসন্ধান । এই আত্ম-অনুসন্ধিৎসু প্রেমিক কবি যখন “তোমার গান” গেয়ে “তোমাকেই” খুঁজতে অনাদি কাল হতে বেরিয়ে পড়েন, তখন তার এই অন্বেষণ তো কোনো বাইরের অনুসন্ধান নয় । মানব-প্রকৃতির মধ্যেই, মানুষের স্বরূপের মধ্যেই রয়েছে ওই অন্বেষণ --- চির না-পাওয়ার  মধ্যেই রয়েছে তার চির-আকাঙ্ক্ষা । তাই এই আকূতির কোনো আদি নেই, নেই কোনো অন্ত  -

কবে আমি বাহির হলেম

১৯১০ (৪৯), তিনধরিয়া, পূজা (বন্ধু), ইমনকল্যান, তেওরা

 

৭) ১৮৮৭ সালে রচিত এই গানটিতে কবির নিবেদনের সুরটিই প্রাণীত হয়ে ওঠে। ঈশ্বরের প্রতি তাঁর যে ভক্তি,তার নেপথ্যে যে উপনিষদের প্রভাব, সেটির অনুরণন যেন ধ্বনিত হয়। কবি জীবন দেবতার কাছে কৃতজ্ঞ । কবি প্রাকৃতিক শোভায় মুগ্ধ, কবি আত্ম পরিজন নিয়েও তৃপ্ত। তবুও, আশা যেন মেটে না। আসলে, কবির তো পরমাত্মার সঙ্গে মিলিত হবার আকাঙ্ক্ষা । তাই ঈশ্বরের পদপ্রান্তে তিনি তাঁর সঙ্গে মিলিত হবার প্রার্থনাই করছেন। অসীমের সঙ্গে মিলিত হবার কথাই তো রবীন্দ্র দর্শন। কিন্তু তা সীমার মধ্যে থেকেই – তাকে লঙ্ঘন করে নয়। তাই সবার কথা বলেই তিনি ঈশ্বরের কথা বলছেন। তবু অসীম যার স্বরূপ, সে অসীমের পূজারীই তো হবে অসীমেই যে তার পরম প্রাপ্তি – “তোমারে না পেলে (সখা), আমি ফিরিব না, ফিরিব না ।”   

অনেক দিয়েছো নাথ

১৮৮৭ (২৬), পূজা (বিবিধ), আশাবরী-ভৈরবী, ত্রিতাল

 

৮) রবীন্দ্রনাথ দুঃখকে দেবত্ব দান করেছেন। তিনি বলেছেন, 'দুঃখের দেবতা তোমাকে স্মরণ করে যা দিয়েছেন তা শান্ত চিত্তে গ্রহণ করো, পৃথিবীতে এসে যে ব্যক্তি দঃখ পেল না, সে লোক ঈশ্বরের কাছ থেকে সব পাওয়া পেল না। 'রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনে কম দুঃখ প্রত্যক্ষ করেননি। বারে বারে মৃত্যু, দুঃখ, অপমান রবীন্দ্রনাথকে শানিত করেছে সৃষ্টিপথে, নির্মোহ করেছে জগৎসংসারে, নস্টালজিক করেছে ক্ষণেক্ষণে। তাই তিনি বলতে পেরেছেন 'আছে দুঃখ আছে মৃত্যু বিরহদহন লাগে। তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।'

আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু

১৯০৩ (৪২), বাল্মীকি প্রতিভা, পূজা (আশ্বাস), মিশ্র-যোগিয়া-ললিত, একতাল

 

৯)  যার জন্ম হয়েছে – তার মরণও আছে । কিন্তু মরণ-পরবর্তী জীবন কিভাবে প্রবাহিত হবে, তার নির্ণয় হয় এই জীবনে । জীবনই যখন থাকছে না তখন মরণ-পরবর্তী জীবন আবার কি? মণীষী কবির সজাগ দৃষ্টিতে সৃষ্টি’র অনন্ত তথা অমরত্ব অনেকটাই ধরা পড়ে যায় । সেই অনন্ত প্রকাশ পায় কবির লেখা কবিতা, গানে এবং তারই প্রতিচ্ছবি স্থান পেয়ে যায় পাঠক-পাঠিকার অন্তরে – বারে বারে – যুগে যুগে । প্রকৃতিপ্রেমিক কবির সৃষ্টি স্থান পেয়ে যায় অনন্ত এই সৃষ্টির মাঝে, স্বাদ লাভ করে অমরত্বের --- কবির সৃষ্টির সাথে সাথে কবিও অমরত্ব লাভ করেন ।

জীবন-মরণ

“আলোচনা” পত্রিকা, কার্তিক ১৮৮৪ (১২৯১)

 

১০) বর্তমান জীবনে বা মরণ-পরবর্তী জীবনেও যে এই জীবন আনন্দের মধ্যেই বিরাজ করবে তার নির্ণয় হয় এই জীবনের সাধনা’র ওপর – সাধনার মানের ওপর । কিন্তু সাধন পথের কঠিন অনুশাসনে ভক্ত কখনও সখনও পথ হারিয়ে ফেলেন । তাই পরম প্রেমময় ঈশ্বরের প্রতি তার কাতর মিনতি – তিনি যেন তাঁর প্রেমের অটুট বাঁধন দিয়ে জীবনের সমস্ত গোলোকধাঁদা থেকে তাঁর এই ভক্তকে চিরতরে উতরে দিয়ে তাঁর চরণকমলে স্থান দেন ।

জানি নাইতো সাধন তোমার বলে কারে

১৫ মার্চ ১৯১৪ (৫২), শান্তিনিকেতন, পূজা (নিঃসংশয়), বাউল, দাদরা


১১) মানুষের মন-প্রাণ সবসময় চায় আনন্দ নিয়ে থাকতে। সেই আনন্দই খোঁজে যা তাকে সুখ দেয়। রবীন্দ্রনাথ ব্যক্ত করেছেন, সুখ যদি প্রতিদিনের চাওয়া-পাওয়া নিয়ে পরিবেষ্টিত থাকে, তবে আনন্দ প্রতিদিনের চাওয়া-পাওয়া’র অতীত। তবে আনন্দ পাই কোথায়? আমরা সাধারণ জীব, কি চাইতে কি চেয়ে ফেলি, তাই শাস্ত্রে কাম”-কে অর্থাৎ কামনা-কে অন্যতম প্রধান শত্রু হিসেবে বলা হয়েছে। শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃতে শ্রীরামকৃষ্ণের মুখে কামিনীকাঞ্চন ত্যাগের কথা মাঝে মধ্যেই উল্লিখিত রয়েছে। কবির আকুল প্রার্থণাতেও সেই একই সুর যেন বাজছে – প্রভু যেন জগতের মায়াবন্ধন কেটে তাঁর চরণে স্থান দেন।  

কাটো হে কাটো হে এ মায়াবন্ধন

রাখো রাখো চরণে এ মিনতি হে

পূজা পর্যায়ের এই গান, কবি রচনা করেছিলেন ১৮৮৫ সালে, মাত্র ২৪ বছর বয়সে।

সংশয়তিমিরমাঝে না হেরি গতি হে

১৮৮৫ (২৪)পূজা, রাজবিজয়, তেওড়া


১২) মনুষ্য জীবনে চলার পথে আমরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিচয় নিয়ে এগিয়ে যাই। জন্মের সাথে সাথে পিতা-মাতা’র পরিচয় নিয়ে জন্মগ্রহণ করি, তারপর স্কুলে পড়ার সময়ে বিদ্যালয়ের পরিচয়ে, স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজের পরিচয়ে, তারপর কর্মক্ষেত্রের বা পেশার পরিচয়ে, তারপর স্বামী অথবা স্ত্রীর পরিচয়ে, তারপরও সন্তানাদির পরিচয়ে – এইভাবে বিভিন্ন পরিচয়ে আমরা পরিচয় হয়ে থাকি। এ ছাড়াও কিছু পরিচয় আছে যেগুলি আমরা সেভাবে হয়তো কোনো গুরুত্ত্ব দিইনি বা বুঝে উঠতে পারিনা, যেমন ঈশ্বরের সঙ্গে আমাদের পরিচয়, আত্মার সঙ্গে দেহের পরিচয়, ইত্যাদি। সময়-নদীর স্রোতে বয়ে চলার মাঝে, আমাদের জীবন-তরী বিভিন্ন ঘাটে বিভিন্ন পরিচয় নিয়ে এগিয়ে চলে। মনুষ্য জীবনে মানুষের অর্থাৎ কিনা “মান” (আত্মসম্মান)ও হুঁশের (সহমর্মিতা) পরিচয় নিয়ে এগিয়ে যাওয়াই কাম্য। জীবন-নদী ঈশ্বর-সমুদ্রে মিলিত হওয়ার আগে, সকলের কণ্ঠেই যেন সেই আকুতি  -  

আমি তোমাদেরই লোক,

আর কিছু নয়,

এই হোক মোর শেষ পরিচয় ।।

পরিচয় (কবিতা)

 --------------------------------------------------------------------------------------

প্রথম দিনের সূর্য

প্রশ্ন করেছিল

সত্তার নূতন আবির্ভাবে-

কে তুমি?

মেলেনি উত্তর

 

বত্সর বত্সর চলে গেল

দিবসের শেষ সূর্য

শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল

পশ্চিম সাগর তীরে

নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়-

কে তুমি?

পেল না উত্তর। 

                                                                      ----- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

(জোড়াসাঁকো, কলিকাতা ২৭ জুলাই, ১৯৪১, সকাল)


আজ যার সামনে এনেছ তোমাদের মালা,

                       তাকেই আমার পঁচিশে বৈশাখের

                            শেষবেলাকার পরিচয় বলে

                            নিলেম স্বীকার করে,

                        আর রেখে গেলেম তোমাদের জন্যে

                           আমার আশীর্বাদ। 

 ----- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

("শেষ সপ্তক")

কৃতজ্ঞতা স্বীকার ---

১) কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তাঁর রচিত “সঞ্চয়িতা” এবং “গীতবিতান”

২) https://www.tagoreweb.in/


-----------------------------------------------------------------------------------------


Tuesday, May 9, 2023

রবির গানে প্রেমের অন্বেষণ - ১

গেয়ে রবি ঠাকুরের গান

ঈশ্বরের (প্রতি) প্রেমে দিই আমি শান্‌

-   শুভেন্দু মাইতি#

 

অন্তর মম বিকশিত কর অন্তরতর হে

নির্মল করো, উজ্জ্বল করো, সুন্দর করো হে ।।

জাগ্রত করো, উদ্যত করো, নির্ভয় করো হে ।

মঙ্গল করো নিরলস নিঃসংশয় করো হে ।।

যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে, মুক্ত করো হে বন্ধ

সঞ্চার করো সকল কর্মে শান্ত তোমার ছন্দ ।।

চরণপদ্মে মম চিত নিস্পন্দিত করো হে

নন্দিত করো, নন্দিত করো, নন্দিত করো হে ।।

(রচনাকাল – ২৭ অগ্রহায়ণ ১৩১৪ (ইং ১৯০৭); ৪৬ বছর বয়সে; স্থান – শিলাইদহ; পূজা পর্যায়; প্রার্থণা উপপর্যায়; ভৈরবী – একতাল)

Ø  Delivered on July 20, 2020, at Trisharan Kripa’s online program.

Ø  Modified on May 01, 2021 – the 125th foundation day of The Ramakrishna Mission Association

Ø  Revised on May 09, 2023 (২৫শে বৈশাখ, ১৪৩০)

The whole universe is one. There is only one Self in the Universe, only One existence. The Self when it appears behind the universe is called God. The same Self when it appears behind the little universe – the body – is the soul.

– Swami Vivekananda (Sankhya and Vedanta)

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান কার না শুনতে ভালো লাগে! মানব জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে, বিভিন্ন সময়ের জন্য রচিত তাঁর গান, জীবনকালের যথাযথ পর্বে বা সময়ে শোনার পর একজন মানুষ মনের শান্তি লাভ করে – রবীন্দ্র-প্রেমিক হয়ে ওঠে। যেমন কথার আন্তরিকতা, তেমনি সুরের আকুলতা - রবীন্দ্রসঙ্গীতের আবেদন মনকে খুব সহজেই মোহিত করে তোলে।  এমনই একটি গান নিয়ে, নিজের মনের ভাবটি প্রকাশ করার নিমিত্তেই এই প্রবন্ধ। গানের প্রতিটি পংক্তিকে নিজের মতো করে মেলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।

 

অন্তর মম বিকশিত কর অন্তরতর হে

অন্তর অর্থাৎ ভিতর – একটি মানবের প্রেক্ষাপটে ‘অন্তর’ বলতে আমরা হৃদয়, মন হিসেবে গ্রহণ করে থাকি। মম অর্থাৎ আমার। এই ‘আমার’ আবার ‘আমি’ থেকে উৎপত্তি (অহং? – রবীন্দ্রনাথ বলেছেন – ‘আমি’র দুটো ভাগ রয়েছে – বৃহৎ আমি বা বড় আমি আর অপরটি ক্ষুদ্র আমি। এখানে ভক্ত আমি রূপে প্রকাশ পেয়েছে যেখানে, আমি দাস তুমি প্রভু, এই অভিব্যক্তি প্রকাশ পেয়েছে)। বিকশিত অর্থাৎ প্রস্ফুটিত । আর, অন্তরতর অর্থাৎ অন্তরের ভেতর বা অন্তরেরও পারে । তাহলে আমরা দেখছি যে, গানের প্রথম পঙক্তিতে একটি প্রার্থণা নিবেদন করা হচ্ছে । কার কাছে প্রার্থণা জানানো হচ্ছে? যিনি অন্তরের গভীরতম জায়গায় বসবাস করছেন । কি প্রার্থণা জানানো হচ্ছে? আমার অন্তরকে প্রস্ফুটিত করো অর্থাৎ আমার হৃদয়কে বিকশিত করো অর্থাৎ উদার করো । এখন দেখুন, আমরা সাধারণতঃ এমনই অস্থির যে আমাদের অন্তরের মতিগতি এমনিতেই ধরা যায় না – আর তাঁর অর্থাৎ অন্তরতরের কাছে সেই প্রার্থণা পৌঁছনো? তাই বিকাশের প্রয়োজন – অন্তরের বিকাশের প্রয়োজন। তবে এই বিকাশ কি ভাবে বা কি রূপে সম্ভব? একটি কুসুমকলি বা কুঁড়ি যেমন ঠিক ঠিক আলো বাতাস জল পেলে একটি ফুলে প্রস্ফুটিত হয়, তেমনি হৃদয়কে যদি সৎ কথা, সৎ পাঠ, সৎসঙ্গে জড়ানো যায়, তবে তার ঠিক ঠিক বিকাশ সম্ভব ।    

 

এবার আমরা গানের দ্বিতীয় পঙক্তিতে চলে যাব।

নির্মল করো, উজ্জ্বল করো, সুন্দর করো হে

নির্মল অর্থাৎ যাতে বা যেখানে ময়লা নেই । নির্মল অর্থাৎ বিমল-ও অর্থাৎ দোষহীন বা বিশুদ্ধ । আমাদের অন্তরে বা মনে যে ময়লা (সংস্কার?) জমে আছে, তা দূর করার উপায় কি? আমরা উপলব্ধি করে থাকি যে আমাদের মনের মধ্যে যে প্রশ্নবাণ আমাদের অস্থির করে তোলে, তা কোনো সৎ ব্যক্তির সঙ্গ লাভ করলে, তাঁর জ্ঞান দিয়ে আমাদের সকল অজ্ঞানতাকে আমরা সরিয়ে ফেলতে সক্ষম হই । যতক্ষণ সেই ব্যক্তির সঙ্গে থাকি, ততক্ষণ আমরা তাঁর সঙ্গ পেয়ে আনন্দ অনুভব করি – আর ঐটুকু সময়ে আমাদের মনের মধ্যে কোনো ময়লা আসতে পারে না – আমাদের অন্তর অর্থাৎ আমাদের মন নির্মল হয় । অর্থাৎ অন্তর নির্মল করার অন্যতম উপায় - সৎসঙ্গ ।

উজ্জ্বল করো অর্থাৎ আলোকিত করো বা দীপ্ত করো । আমাদের অন্তর দীপ্ত হবে কিভাবে? – সৎজ্ঞান । আমরা যারা কোনো ঈশ্বর (ভগবান, যীশু, আল্লাহ, বুদ্ধ, ইত্যাদি)মানি, সেই ঈশ্বরের  কথামৃত (গীতা বা শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত, বাইবেল, কোরাণ, ত্রিপিটক, ইত্যাদি)পাঠের মাধ্যমে আমরা যেন সেই ঈশ্বরের চিন্তা-ভাবনা, তাঁর কথা, তাঁর উপদেশ পেয়ে যাচ্ছি যা আমাদের অন্তরের অন্ধকারের মধ্যে আলোর দিশা দিয়ে চলেছে – আমাদের অন্তর যেন তাঁর বাণীতে নিরন্তর দীপ্ত বা আলোকিত হচ্ছে ।

সুন্দর অর্থাৎ দেখতে ভালো এমন বা সুদৃশ্য, মনোহর, রূপবান । ভক্ত মানবের হৃদয় কিসে সুন্দর হবে? সুন্দর হবে ঈশ্বরের রূপ দর্শনে, তাঁর রূপ চিন্তনে – তাঁর ধ্যানে । তাঁর নির্মল, উজ্জ্বল রূপ ধ্যান করতে করতেই আমাদের অন্তর বা হৃদয় সুন্দর হয়ে উঠবে ।

 

গানের পরের পঙক্তিতে চলে যাব।

জাগ্রত করো, উদ্যত করো, নির্ভয় করো হে

জাগ্রত অর্থাৎ সজাগ বা বিনিদ্র কবি এখানে সতর্ক থাকার প্রার্থণা জানাচ্ছেন – আমরা দেখছি যে বিভিন্ন কঠিন পরিস্থিতিতে যেমন Covid19-এর মত মহামারী বা অতিমারী পরিস্থিতিতে, আমাদের সজাগ থাকতে বারংবার বলা হয়েছে কারণ অসাবধান হলে নিজের সঙ্গে সঙ্গে আরও ৫ জনের ক্ষতি হতে পারতো! তেমনি যদি আমরা নিজ নিজ সংস্কারে আবদ্ধ হয়ে থাকি এবং ভাবি যে নিজ নিজ জলাধারে আমরাই সেরা যা কিনা আমাদের অহং-এরই বহিঃপ্রকাশ (জলাধার শব্দটি এখানে ব্যবহার করা হয়েছে, আমেরিকার চিকাগোর ভাষণে স্বামী বিবেকানন্দের কূপমণ্ডুক গল্পটি উল্লেযোগ্য বলে), তবে আমরা প্রত্যেকেই মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যাব এবং আরও কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হব। কঠিন পরিস্থিতি কি? কঠিন পরিস্থিতিটি হল, আমরা অন্তরতর অর্থাৎ আমাদের আপনার চেয়েও আপনার যে জন, তাঁর থেকে দূরে সরে যেতে থাকব! তাঁর থেকে দূরে সরতে থাকলে আমাদের কষ্ট। আমরা যে তাঁর হাতের যন্ত্র মাত্র! আমাদের তো তাঁর কাজেই অধিকার - কর্মফলে নয় !

উদ্যত করো অর্থাৎ প্রবৃত্ত করো বা উন্মুখ করো । উদ্যত হতে আমাদের উদ্যম প্রয়োজন অর্থাৎ উৎসাহ, অধ্যবসায়, উদ্যোগ বা উপক্রম প্রয়োজন । এখানে প্রার্থণা করা হচ্ছে - হে অন্তরতর, উদ্যত করো অর্থাৎ আমাদের মধ্যে উৎসাহের ফোয়ারা ছুটিয়ে আমাদের নিজ নিজ কর্তব্য পালনে প্রবৃত্ত করো !

নির্ভয় অর্থাৎ ভয়হীন । কর্তব্য করতে গিয়ে আমাদের সংস্কার পিছু টানে – কে কি ভাববে! কে কি বলবে! -- হেরে যাওয়ার ভয় – অবহেলিত হওয়ার ভয় – হ্যাঁ, এমনকি প্রাণেরও ভয় – এবং সেই ভয়ের জন্যই মানুষ মান ও হুঁশ উভয়েরই বিস্মৃত হয় । কর্তব্য থেকে আমরা পালিয়ে যাই বা কর্তব্যকে অবহেলা করি । তাই অন্তরের ব্যাকুল প্রার্থণা অন্তরতরের অকুতোভয় আশীর্বাদে যেন স্নাত হয়ে আমরা আমাদের কর্তব্য পালনে সর্বদাই সচেষ্ট থাকি ।    

 

এবার আমরা গানের পরের পঙক্তিতে চলে যাব।

মঙ্গল করো নিরলস নিঃসংশয় করো হে ।।

মঙ্গল করা অর্থাৎ কল্যাণ করা বা হিত সাধন করা । হিত সাধন অর্থাৎ কারুর জীবনে সুখ-সমৃদ্ধি যুগিয়ে দেওয়া । নিরলস অর্থাৎ অনলস ভাবে বা আলস্যহীন । নিঃসংশয় অর্থাৎ সংশয়হীন বা সন্দেহশূণ্য অবস্থা অথবা নিশ্চিত হওয়া ।

গানের আগের পঙক্তিতে আমরা আলোচনা করছিলাম যে আমরা যেন কর্তব্য পালনে সচেষ্ট থাকি । কাজ তো করবো? কিন্তু কি ভাবে? – কবি বলছেন, নিরলস হয়ে – বাড়িতে ঠিক যেমন মা কখনও সখনও তাঁর শারীরিক অসুস্থতাকে অগ্রাহ্য করে তাঁর সন্তানদের মুখেখা বার তুলে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগেন ! শুধু কি খাবার? সমস্ত কাজেই উনি তাঁর প্রাণটি ঢেলে দিচ্ছেন – অহৈতুকি । তাঁকে তাঁর সন্তানরা যেমন ভাবেই দেখুক না কেন, তিনি নিরলস ভাবেই সেবায় মত্ত এখানে মনের মধ্যে একটা প্রশ্ন জাগে – একই কর্মে এই যে একজন অলস আর একজন খুবই সপ্রতিভ, তা কি আমাদের নিজ নিজ মনের কারণে? কথায় তো আছে – মনেই বদ্ধ, মনেই মুক্ত ।

আর একটি কথা – আমরা কাজ করবো কল্যাণ কামনায় – নিজের, পরিবারের তথা সমাজের কল্যাণের জন্য । আমরা চাকরি করি বা না করি, চাষীই হই বা শ্রমিকই হই, ছাত্র, ছাত্রী, গৃহী, সন্ন্যাসী বা স্বেচ্ছাসেবী যাই হই না কেন, আমাদের জন্ম নির্দিষ্ট কর্মের জন্য। আমাদের ভুললে হবে না আমরা প্রত্যেকেই প্রত্যহ এইরকমই বহু কর্মীর কল্যাণে নিজেদের জীবন অতিবাহিত করে চলেছি – সে যে মা বাসন ধুয়ে দিয়ে যাচ্ছেন, যিনি জামা কাপড় কেচে দিয়ে যাচ্ছেন অথবা যে মা রান্না করে দিয়ে যাচ্ছেন – তাঁরা যদি কল্যাণ না করেন আমরা কিরকম অসহায় হয়ে পড়ি । তেমনি আমাদের প্রত্যেকের আবির্ভাব (ঈশ্বর) নির্দিষ্ট কর্মধারায় নিজেদের নিয়োজিত করে জগত কল্যাণকর বা হিতকর কাজ করে যাওয়া - এই ব্যাপারে যেন আমরা কোনোরকম সংশয়ে না থাকি – (হে প্রভু,)নিঃসংশয় করো হে !       

 

গানটির পরের পঙক্তিতে চলে যাব আমরা।

যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে, মুক্ত করো হে বন্ধ

যুক্ত করা অর্থাৎ মিলিত করা বা একত্রিত করা । একটি ফুল একক ভাবে প্রভুর চরণে স্থান পায় । একটি ফুল দিয়ে মালা গাঁথা সম্ভব হয় না । কিন্তু যখন অনেকগুলি ভিন্ন ভিন্ন রকমের ফুল দিয়ে সূচ-সুতো সহকারে একটি সুন্দর মালা গাঁথা হয়, তখন সেটি স্থান পায় গলায় – অন্তরের সন্নিকটে । আমরা প্রত্যেকে হয়তো সারাদিনে WhatsAppএ কোনো মেসেজ পড়ছি, Facebook কোনো মেসেজ পড়ছি বা ভিডিও দেখছি, YouTubeএ ঈশ্বর সম্বন্ধীয় কোনো ভিডিও দেখছি এবং আনন্দ পাচ্ছি, তথাপি সমবেত হয়ে অনলাইনে (ধরুন Google Meet, Facebook বা YouTube live, ইত্যাদি) বা অফলাইনে যখন কোনো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমরা ঈশ্বরীয় আলোচনা করি বা সমবেত ভাবে শুনি, তখন আমাদের মধ্যে আনন্দের প্রকাশ একটু বেশি মাত্রায় ধরা দেয় । তখন ঈশ্বরকে (বা আমাদের মধ্যে অন্তরতরকে) আমরা সমবেত ভাবে পাই। একসাথে, একযোগে তাঁর স্মরণ-মনন করলে, তিনি যেন এক ধাপ এগিয়ে এসে ধরা দেন । এই যে সবাই মিলে কোনো কাজ করলে, আনন্দ বেশি মাত্রায় ধরা দেয় – এই অনুভূতি আজকের নয় । তাই তো কথায় আছে –“সবে মিলি করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ” । তাইতো বাড়িতে, পাড়াতে, জাতিতে, বিভিন্ন পরব, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়ে থাকে! তাইতো কবির বিনীত প্রার্থণা – যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে

মুক্ত অর্থাৎ অবারিত, আবদ্ধহীন, অবরুদ্ধহীন, স্বাধীন । শুক্ল যজুর্বেদের বৃহদারণ্যক উপনিষদ থেকে আমরা জানতে পারি – সর্বে ভবন্তু সুখিনঃ সর্বে সন্তু নিরাময়াঃ সর্বে ভদ্রাণি পশ্যন্তু, মা কশ্চিত দুঃখভাগভবেত্‌ । ঈশ্বরের কাছে আমাদের সকলের প্রার্থণা – সবাই যেন সুখী হয়, সকলেই যেন রোগমুক্ত হয়, সকলেরই যেন ভালো হয়, কেউ যেন দুঃখের ভাগীদার না হয় । অর্থাৎ আমাদের ভাবনাতে যেন মুক্তি আসে – ‘আমি’ থেকে ‘আমরা’, ‘আমার’ থেকে ‘আমাদের’ । কবি (এবং আমাদের অন্তর) সেইরকমই প্রার্থণা করছেন – আমাদের নিজস্ব আনন্দ যেন বাঁধা পড়ে যায় সকলের আনন্দের পরশে – পরানন্দে । আর ‘সবার’ মধ্যে ‘আমি’ তো এমনিতেই এসে পড়ছি!

 

সঞ্চার করো সকল কর্মে শান্ত তোমার ছন্দ ।।

সঞ্চার অর্থাৎ বিস্তার, ব্যাপ্তি, প্রতিষ্ঠাকরণ আবার সৎসংক্রমণও ভাবতে পারি । (যোগ ব্যতীত) যে কোনো কর্মে অস্থিরতা আসে । নিজ নিজ কর্ম নিয়ে যখন আমরা সকলে মিলিত হই, তখন আমরা অস্থির হয়ে উঠি নিজ নিজ কথা বলার জন্য, শোনানোর জন্য – তাতে অনেক সময়ে যেটা অসুবিধা হয় – কারুর কথা স্পষ্ট ভাবে শোনা যায় না । কিন্তু অস্থিরতা ত্যাগ করে, শান্ত হয়ে, যখন আমরা সবাই একযোগে কোনো অনুষ্ঠান দেখি বা বক্তৃতা শুনি, যেমন ধরুন কোনো ধর্মগ্রন্থ পাঠ হচ্ছে বা ঈশ্বরীয় লীলা সম্বন্ধে আলোচনা হচ্ছে, বা কোনো হলঘরে কোনো সংগীত পরিবেশন বা কোনো বক্তৃতা হচ্ছে, তখন যেন ঐ পাঠ বা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অন্তরাত্মা বেশি করে ধরা দেন ।

অন্য একটি উদাহরণে যাই । এক বিদ্যালয়ের একটি ক্লাসের মধ্যে শিক্ষক পড়িয়ে চলেছেন । একটি ছাত্র একটি অংশ বুঝতে না পারায় শিক্ষককে জিজ্ঞাসা করেছে । শিক্ষক ছাত্রটির প্রশ্ন বুঝে ও বোঝাতে গিয়ে ক্লাসের বাকি ছাত্রেরা নিজেদের মধ্যে কথা বলাবলি করছে – ক্ষণিকে ক্লাসটি অশান্ত হয়ে পড়ায়, শিক্ষক গম্ভীর হয়ে বলে উঠলেন – “Why are you shouting? Have you all understood whatever has been discussed in the class? I want pin drop silence in the class (“তোমরা উঁচু স্বরে কেন কথা বলছো? আজকের আলোচনার সবটা কি তোমরা বুঝতে পেরেছ? আমি এমন নিস্তব্ধতা চাই যেখানে মাটিতে পিন পড়ার শব্দও শোনা যাবে”) । শিক্ষক ধরিয়ে দিচ্ছেন – শিক্ষা আহরণে শান্ত হওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন ।   

কখনও সখনও কারু কারু কর্মের ঠেলায় প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে পড়ে – যেমন ধরুন উচ্চৈঃস্বরে মাইক বাজিয়ে গান শুনিয়ে আনন্দ দেওয়ানোর চেষ্টা । তখন মন (অন্তর) যেন আপনা আপনিই বলে ওঠে – ‘আরে বাবা! ডাকতে হলে মনে মনেই ডাক না!’ কোথাও যেন মনে হয় ছন্দপতন – কারণ অন্তরতর তো শান্ত আবহেই ধরা দেন বা দিতে চান! এবং তাইতো আমরা মন্দিরে, মসজিদে, গীর্জা’তে তাঁকে আকুল ভাবে ডাকতে প্রবৃত্ত হই! তাই এখানে, কবির (এবং আমাদের অন্তরেরও) আকুল প্রার্থণা – আমাদের প্রতিটা কাজে যেন তাঁর ঐ শান্ত ছন্দ ধরা পড়ে ।    

 

চরণপদ্মে মম চিত নিস্পন্দিত করো হে

চরণপদ্ম অর্থাৎ চরণকমল অর্থাৎ পায়ের শেষভাগ । চিত অর্থাৎ মন, হৃদয়, অন্তঃকরণ । নিস্পন্দিত অর্থাৎ স্থির, নিশ্চল, স্পন্দনহীন । অভিধানে উল্লেখ রয়েছে, স্পন্দন অর্থাৎ ঈষৎ কম্পন, স্ফূরণ – ক্রমাগত পর্যায়ক্রমে গতি ও বিরাম – অভিধানে দেওয়া এই শব্দার্থের তাৎপর্য আমরা “হৃদস্পন্দন” শব্দের মাধ্যমে অনুভব করতে পারি ।

হিন্দু ধর্মে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম একটি শুভ সংস্কার হিসেবে গৃহীত – আমরা গুরুজনদের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম জানিয়ে তাঁদের আশীর্ব্বাদ কামনা করি । সেইটিরই ভিন্ন প্রকাশ ঈশ্বরের পাদপদ্মে পুষ্পাঞ্জলী অর্পণ । ছোটবেলা থেকে আমরা দেখে এসেছি, সাধারণতঃ আমরা পুষ্পাঞ্জলী আমাদের আরাধ্য দেবতার চরণে তিনবার নিবেদন করেছি। এ যেন তাঁর প্রতি অর্থাৎ সেই আরাধ্য দেবতার প্রতি প্রাণের যে স্পন্দন, তা বার বার নিক্ষেপ করা অর্থাৎ বারংবার তাঁতে স্মরণ নেওয়া ও তাঁকে পাওয়ার চেষ্টা করা । পুষ্পাঞ্জলীর শেষে ভূমিষ্ঠ বা নতজানু হয়ে প্রণাম – ফুল-বেলপাতার মতো আর কোনো সাজসজ্জা নেই – অর্থাৎ, ঠাকুর, এইবার মনটি নাও – যেন অবিরাম তৈলধারার মত তোমার চরণকমলে স্থান পাই – কবির কথায় তোমার রাঙা চরণে আমায় নিস্পন্দিত করো হে !

এখানে একটা প্রশ্ন – স্পন্দনহীন মানে তো জড়; জড় বস্তুর তো কোনো অনুভূতি থাকতে পারে না ! তবে ঈশ্বরের চরণকমলে মন সঁপে দেওয়ার যে আনন্দ সেটি কি করে অনুভূত হবে? এইখানে আমাদের বুঝতে হবে যে স্পন্দন বলতে এখানে মায়া’র জগতকে বোঝানো হচ্ছে যা কিনা আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের গোচরে আসে । ঐ পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের দ্বারাই আমরা জগত সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হই । আবার ঐ পঞ্চ ইন্দ্রিয়ই আমাদের মন তথা অন্তর’কে আমাদের অন্তরতর বা অন্তরাত্মা থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায় । তাই অন্তরতরকে জানতে হলে আমাদের জগত(স্পন্দন) থেকে নজর সরাতে হবে । দ্বিজেন চৌধুরী রচিত, স্বনামধন্য সঙ্গীত শিল্পি পান্নালাল ভট্টাচার্য্যের সুললিত কণ্ঠে পরিবেশিত বহু পরিচিত একটি শ্যামাসংগীতের দুইকলি এখানে প্রাসঙ্গিক হবে বলে মনে হয় –     

.......................................

আমার তাই তো লাগে ভয়

প্রলোভনের ফাঁদে পড়ে হই বুঝিবা ক্ষয়

ওরে যেন ভুলিস না তোর দয়াময়ী মা

তার রক্তমাখা কালোরূপে ঘুচায় কালিমা

ও মন তাই বলি আয় ঐ রাঙা পা’য় করি আত্মসমর্পণ ।।

আমার মায়ের পায়ের জবা হয়ে ওঠনা ফুটে মন

তার গন্ধ না থাক যা আছে সে নয়রে ভুয়ো আভরণ ।

    

আমরা গানের শেষ কলিতে এসে পৌঁছেছি ।

নন্দিত করো, নন্দিত করো, নন্দিত করো হে ।।

নন্দিত অর্থাৎ আনন্দিত অর্থাৎ আনন্দ দেওয়া হয়েছে এমন বা তুষ্ট করা হয়েছে এমন। কবি এখানে নন্দিত করো তিনবার উচ্চারণ বা প্রার্থণা করেছেন – ঠিক যেমন কোনো বৈদিক মন্ত্রে আমরা উচ্চারণ করে থাকি - শান্তি, শান্তি, শান্তি । তিনবার শান্তি উচ্চারণের বিভিন্ন রকম ব্যাখ্যা পাওয়া যায় । এক – আমরা যে তিন অবস্থার (চেতনা) মধ্যে থাকি অর্থাৎ জাগ্রত, সুপ্ত বা নিদ্রিত, এবং স্বপ্নাবস্থা – এই তিন অবস্থাতে যেন আমরা শান্তিতে অবস্থান করি#২ । দুই – যে তিন লোকের কথা বলা হয়, স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল – এই তিন লোকের মধ্যে সমন্বয় স্থাপণ করে যেন শান্তি বিরাজ করে । তিন – তিনবার শান্তি মন্ত্র উচ্চারণে আমাদের শরীর, মন ও আত্মা’র জ্বালা যন্ত্রণা প্রশমিত বা শান্ত হয় ।

আরও যে ব্যাখ্যা চলে এসেছে উপনিষদ্‌ থেকে তা হল তিনবার শান্তি উচ্চারণ, তিন ধরণের বিপদ থেকে উদ্ধার পাবার জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থণা নিবেদন#৩ । তিন ধরণের বিপদগুলি কি কি? – আধিভৌতিক, আধিদৈবিক ও আধ্যাত্মিক দুঃখ । আধিভৌতিক বিপদ হল প্রাণী থেকে আসা বিপদগুলি, সে কীটপতঙ্গ হতে পারে, বাঘ ভাল্লুক হতে পারে আবার Covid19এর মত জীবাণুও হতে পারে । আধিদৈবিক বিপদ হল প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে আসা বিপদগুলি যেমন বাংলায় আমফান (২০২০) ঝড়, ভূমিকম্প, বন্যা, ইত্যাদি । আধ্যাত্মিক বিপদ হল মানসিক পীড়া, অস্থিরতা । বাড়িতে কোনো প্রিয়জন যদি অনেকক্ষণ অনুপস্থিত থাকে বা প্রিয়জনের অসুখ করে, তখন মন অস্থির হয়ে ওঠে । আবার কোনো পরীক্ষা দিতে যাচ্ছি, তখনও মনে অস্থিরতা । প্রথম দুটি ক্ষেত্রে বিপদ বাইরে থেকে আসে, কিন্তু তৃতীয়টির ক্ষেত্রে বিপদ আসে ভিতর থেকে – মন থেকে । আধি অর্থাৎ দুশ্চিন্তা, ভাবনা, উৎকণ্ঠা বা বিপদ । অর্থাৎ আধি থেকে উৎপত্তি মানসিক পীড়া, যা দৈহিক পীড়াতেও প্রতিফলিত হয় । রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন – ‘ব্যাধির চেয়ে আধি হল বড়ো’#৪

তাই কবির কলমের সাথে সাথে আমাদেরও অন্তর (হৃদয়) সেই অন্তরতর’র (অন্তরাত্মা) কাছে প্র্রার্থণা জানাচ্ছে – সেই আধ্যাত্মিক শক্তির কাছে – এই বিপদ সকলের আকর্ষণ থেকে তিনি যেন আমাদের অন্তরকে রক্ষা করেন – আমাদের উদ্ধার করেন । হে প্রভু, আমাদের আনন্দের পথের শরিক করো – আনন্দিত করো, আনন্দিত করো, আনন্দিত করো ।

 

তাহলে আমরা, সম্পুর্ণ গানটি কোন ভাব নিয়ে শুনতে পারি?- সকালের শান্ত পরিবেশে সূর্যরশ্মির নির্মল আলো পেয়ে সূর্যমুখী’র কলি’র পূর্ণরূপে প্রস্ফুটিত হওয়ায় অন্তররূপ মৌমাছি সূর্যমুখীর ‘অন্তরতর’ পরাগের প্রেমরূপ মধু আহরণে নিস্পন্দিত চিত্তে নিরলসভাবে সচেষ্ট।

 

রবি ঠাকুর নিজেই জানিয়েছিলেন, মানুষ তাঁকে তাঁর সঙ্গীতের মধ্যে মনে রাখবে। এমন আবেদন ও আকুলতা যেখানে, সেখানে একজন শ্রোতার তাঁর গানের প্রতি আকর্ষিত না হয়ে উপায় আছে কি?

----------

কৃতজ্ঞতা স্বীকার

১) অনলাইন বাংলা অভিধান

২) https://www.yogapedia.com/definition/9152/om-shanti

৩) “শান্তিঃ। শান্তিঃ। শান্তিঃ।।” – স্বামী সুপর্ণানন্দ, মার্চ-এপ্রিল সংখ্যা, শাশ্বত নির্ভীক পথিক, ২০১৯

৪) “ফাঁকি” – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর https://rabindra-rachanabali.nltr.org/node/10869

 

 #লেখক পরিচিতি

লেখক, পশ্চিমবঙ্গে, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার খড়্গপুরের হিজলি কো-অপারেটিভ সোসাইটি নিবাসী এবং মেঘালয়ের শিলংয়ে একটি সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত।

email - subhendumaity@gmail.com